আজ খ্যাতিমান সাংবাদিক ওরিয়ানা ফাল্লাচির “ লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ণ ’’ এর পাঠ প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিঠি লিখবো। ‘‘হাত বাড়িয়ে দাও’’ নামে বইটির অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
‘মানুষ’ শব্দটি চমৎকার, কেননা এই শব্দে কোনো নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। তুমি হয়তো জানো- হৃদয় এবং মস্তিষ্কের কোনো নারী পুরুষ ভিন্নতা নেই। ব্যবহারেও নয়। এই সত্যটি যদি তুমি মনে রাখো এবং হৃদয় ও মস্তিষ্ক সম্বলিত একজন ব্যক্তি মতো আচরণ করো তাহলে অন্যদের মতো ছেলে অথবা মেয়ে হিসেবে দেখবে না। আমি শুধু চাইবো ভিতু শব্দের, যার মতো ঘৃণ্য কোনো বিশেষণ নেই, সকল চিহ্ন তুমি মুছে ফেলবে। এই ভীতি মানুষকে মানুষ হতে দেয় না, কুরে কুরে খায়। কখনোই তুমি ঝুঁকি এড়াতে চাইবে না- যত ভয়ই তার সঙ্গে থাকুক না কেন ! জীবন সম্পর্কে এখনও তুমি কিছু জানো না। জীবন একটি যুদ্ধ, প্রতিদিনের- প্রতিমুহূর্তের। প্রতি বিন্দু আনন্দের জন্যে এখানে জীবনকে কঠোর মূল্য দিতে হয়। পৃথিবীতে আসাই একটি ঝুঁকির কাজ। কাজেই পৃথিবীতে এসে ঝুঁকি এড়ানোর আর কোন পথ নেই। কষ্ট বা ব্যথাকে ভয় করে কে কবে বড় হয়েছে ? আমাদের জন্ম এই ব্যথার মধ্যে, ব্যথা নিয়েই আমরা বেড়ে উঠি এবং ক্রমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতো ব্যথাকেই সঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই।
মা-রে, একজন পুরুষের অনেক সুবিধা আছে, আছে সীমাবদ্ধতাও। গতকাল পর্যন্ত মনে হতো এটা সুবিধা, আজ সেটিকেই মনে হতে পারে সীমাবদ্ধতা। পুরুষ হলে ঝামেলা অনেক কম হবে। অন্ধকার রাস্তায়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, থানায় বা হাসপাতালে ধর্ষিতা হবার ভয় থাকে না। প্রয়োজন হয় না বুদ্ধিবৃত্তি ঢেকে মসৃণ শরীর বানানোর। মানুষ কখনোই বলবে না তুমিই সৃষ্টির আদি ও প্রধান পাপ। জীবন সংগ্রাম হয়তো অনেক সহজ হবে।
তুমি তখন প্রয়োজনীয় অবাধ্যতার জন্য অপমানের শিকার হবে না, ভালোবাসার ‘দায়’ হিসেবে গর্ভধারণের ভয় থাকবে না। যদিও নারী হলে নিজের শরীরের ভিতর আরেকটি জীবন লালন করার মাঝে গর্ব আছে, গর্ব আছে একজনের মধ্যে দুই জনকে অনুভব করার মধ্যে। যা পুরুষ পারে না। মা হওয়া ব্যবসা নয়, দায়িত্বও নয়। এটি হচ্ছে আরও অধিকারের মতোই আরো একটি অধিকার। এসব সত্য তুমি খুব কম জনকেই বিশ্বাস করাতে পারবে। প্রায়শ: তোমাকে পরাজিত হতে হবে। কিন্তু এতে হতাশ হবার কিছু নেই।
বন্ধু আমার, বন্ধু এত তাড়াতাড়ি হয়তো তোমার কাছে এসব কথা বলা ঠিক নয়। হয়তো এ মুহূর্তে বাজে এবং কুৎসিত সব সত্যগুলো চেপে রেখে সুন্দর এবং নিষ্পাপ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
কিন্তু সেটা তোমাকে ফাঁদে ফেলার সামিল হবে। এর অর্থ হবে- জীবন একটি নরম কার্পেটের মতো, সেখানে তুমি খুব কোমল পায়ে হেঁটে বেড়াতে পারো ইত্যাদি । অথচ জীবন হচ্ছে পাথর-ফেলা রাস্তার মতো- গর্ত আর নুড়ি পাথরে ভর্তি। যেখান দিয়ে চলতে তোমার অনেক কষ্ট হবে, হোঁচট খেতে হবে বারবার। জখম হতে হবে, লোহার জুতো পরেও রক্ষা পাবে না। লোহার জুতো পরে হয়তো পা বাঁচবে কিন্তু আশেপাশে এমন অনেকেই থাকবে যারা তোমার মাথায় পাথর মারবে। তোমাকে বার বার কাঁদতে হবে।
বিন্নি ধানের খঁই ! ‘‘যারা বেশি কাঁদে তারাই মন খুলে হাসতে পারে। এ পৃথিবীতে কাঁদা সহজ, হাসা কঠিন। এই সত্যটি বুঝতে তোমার খুব বেশি সময় লাগবে না। সব কিছুই তোমাকে কাঁদাবে- ক্ষুধা, ক্রোধ, চারপাশের সবকিছুই। হতাশ হয়ো না। তোমারও হাসি পাবে-যখন হাসবে তখন সেটুকু আমাকে দিও। স্বাধীনতা সম্পর্কে বহু কথা তুমি শুনবে। ভালোবাসা’র মতোই বহুল ব্যবহৃত এবং বহুল প্রতারিত একটি শব্দ। এমন মানুষের সঙ্গে তোমার দেখা হবে যারা ‘স্বাধীনতা’র জন্যে কঠোর আত্মত্যাগ করছে, অত্যাচারিত হচ্ছে এমনকি মৃত্যু বরণ করছে। তবু আমি চাই তুমি তাদের মতোই একজন হও। তুমিও দেখবে এর জন্যে তোমাকেও অত্যাচার সইতে হবে। আস্তে আস্তে যখন আরও বড় হবে - তখন তোমাকে অনেক বাধাঁর সামনে পড়তে হবে। তোমার নিজস্ব চিন্তা অনুভূতিও বাধাগ্রস্থ হবে। অনেকেই বলবে, এগুলো হচ্ছে পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধনের ব্যাপার। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য নানাপ্রকার আজেবাজে আইন-কানুন দিয়ে মানুষকে বশ করবার জন্যে এগুলো বানানো হয়েছে। সমাজ তোমার গলায় দড়ি লাগাবে- জল্লাদের চাইতেও তারা কঠোর। তোমাকে মানুষ হতে হলে এই অদৃশ্য দড়ি ছিড়তে হবে।’’
মা-রে ‘‘সিমোন দ্য বেভোয়ার’’ এর কথায় ঠিক ‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ কেউ নারী হয়ে ওঠে’। জন্মের সময় একটা শিশু জানেনা সে নারী না পুরুষ। নারীর যতটুকু নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করে, সমাজ তার‘চে বেশী তাকে নারী করে তোলে। প্রতি পদে তাকে টিপ পরিয়ে, ঝুঁটি বেঁধে, পুতুল খেলিয়ে, রান্নাবাটি ধরিয়ে দিয়ে, বাইরে ঘোরা বন্ধ করে, পা ছড়িয়ে বসলে শশুরবাড়ি দূরে হবে বলে, সরহলুদ মাখিয়ে সামাজিকভাবে তাকে মেয়েলি করে তোলা হয়। তার সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় কোড অব কন্ডাক্টের বিধিনিষেধ। আচরণে, আলাপচারিতে, সাহিত্যে, দর্শনে, গানে, কবিতায়, ঠাট্টায়, পোশাক নির্বাচনে এই লিঙ্গনির্মান চলতে থাকে অনিঃশেষ.., তৈরী হয় অসাম্য ও বঞ্চনার অদৃশ্য চোরাবালি।’’
মারে, কোথায় যেন পড়েছিলাম জীবনটা পেঁয়াজের মতো। খোসা ছাড়াতে গেলে চোখে জল আসে বটে, কিন্তু খোসা না ছাড়ালে পেঁয়াজের স্বাদ মেলেনা। জীবনের স্বাদ পেতে হলে নিজের সংষ্কার, ভয়, জড়তা ও দ্বিধার খোসাগুলো চোখ মুছতে মুছতে নিজেকেই ছাড়াতে হবে। মারে, তখন চোখ মুছতে তোমার নিশ্চয়ই টিস্যু লাগবে? আমি টিস্যু হয়ে তোমার চলার পথ আগলে দাড়িয়ে রইলাম।
প্রতিষ্ঠাতা, স্টুডেন্ট অব দা ইয়ার।