প্রত্যেকের নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করার এমন কি ভুল করার অধিকার থাকা চাই, নইলে সমাজের প্রাণ থাকে না। প্রাণ সঞ্চারি ব্যাপারে- যেমন বিয়ে, পেশা নির্বাচন, বন্ধুনির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে যদি তরুণরা বৃদ্ধের উপদেশ মেনে চলে তো ভুল করবে। যে জাতির তরুণরা এসব বিষয়ে স্বাধীনতার পরিচয় দিতে পারে না, সে জাতি মৃত, তার কাছ থেকে পৃথিবী ভালো কিছুই আশা করতে পারে না। কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কুতি কথা’ বইয়ের ‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’ প্রবন্ধের শুরুর বাক্যটির সহজ ব্যাখ্যা করলে এমনটি হয়। আজ আমার প্রিয় বইটির অতিপ্রিয় একটি প্রবন্ধের পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখছি।
আম্মু, সময় ও সুযোগের ‘অপচয়ের ভয়ে নিজেকে সংকুচিত করবে না। জীবন যে ধনী, অপচয়ের দ্বারাই তা প্রমাণিত হয়। অতএব ভাবনা কি? একেবারে নির্ভুল জীবন-যাপনের চেষ্টা ভালো নয়। প্রাণশক্তির অভাব ঘটে বলে তাতে জীবনে মর্চে পড়ে।’ তেলাপোকার মতো গর্ত ও অন্ধকারবাসী হয়ে দীর্ঘায়ু মর্চে ধরা জীবনের চেয়ে, প্রাণময় স্বল্পায়ু জীবন ঢের ভালো। দীর্ঘায়ু বা সার্থক না হলেই যে তোমার জীবনটা বরবাদে গেল তা নয়। বরং ‘ব্যর্থ লোকেরাই সমাজকে সমৃদ্ধ করে তোলে। যে সমাজে যত ব্যর্থলোকের বাস, সে সমাজ তত ধনী। ...আমি বলছি ‘সাধনার ব্যর্থতার কথা। সত্য সুন্দর বা কাল্পনিক কল্পনার ফলে যে ব্যর্থতার আবির্ভাব হয় সে ব্যর্থতার কথা। “Say not the Struggle nought Availeth”
‘সাধনার দ্বারা সোনা হতে চেয়ে যদি তুমি ব্যর্থকাম হন তো তাতে দুঃখ নেই। কেননা, সোনা না হলেও তুমি কষ্টিপাথর হবেই। আর সংস্কৃতি-ক্ষেত্রে কষ্টিপাথর হওয়াটাও কম কথা নয়। কষ্টিপাথর হওয়ার দরুন সোনা কি চিজ তা তুমি সহজেই বলতে পারবেন। তাই সভ্যতা-সৃষ্টির ব্যাপারে তুমি মূল্য অনেক- এমন কি প্রতিভাবানের চেয়েও বেশী।’ ... ‘যে সমাজে সমজদার যত বেশী সে সমাজ তত বেশী সভ্য। সমজদারি মানে মূল্যবোধ। প্রতিভা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি তুমি ব্যর্থ হও তো তাতে বিশেষ দুঃখ নেই।’ কেননা পরিণামে তুমি সমজদার হবেই, আর সমজদার হলেও সমাজের লাভ। ‘মানুষের দু’টো ক্ষমতা-নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আর সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা, নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা প্রতিভাবানের, সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রসিকের বা সমজদারের। সাড়া দেওয়ার ক্ষমতার অনুশীলনেই জীবন শিল্পম-িত হয়। ...সমজদারী মানে মূল্যবোধের অনুশীলন।...মানুষের চলার পথটি সহজ করে দেওয়া নয়; কঠিন পথটি আনন্দময় করে তোলাই তার কাজ। শ্যামের বাঁশীর দিকে কান রেখে পথের কাঁটা দলে চলার কায়দাটি সে বাতলে দেয়।’
‘গল্প কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির দ্বারা সকলেই মানুষকে চমকে দিতে চায়, শিল্পসাহিত্যের প্রভাবে এসে নিজেকে সুন্দর ও মহান করে তুলতে চায় কম লোকই। আত্মমার্জিতির দিকে নয়, আত্মপ্রকাশের দিকেই সকলের ঝোঁক। সকলেই চায় প্রতিষ্ঠা। ... মানসভা-ার পূর্ণ করে নেওয়ার দিকে ঝোঁক নেই বলে অধুনা মানুষের অন্তর-জীবনটা ফাঁকা ও ফাঁপা হয়ে পড়ছে। গভীর অনুভূতিতে মূক হয়ে যাওয়ায়, নীরবতার গানে কান পাতার প্রবৃত্তি কারো ভেতরেই নেই। সকলেই চায় কেবল দিতে, নিতে নয়। .. সকলের মুখে কেবল বিশ্বের কথা, নিজের কথা, নিজের অন্তরাত্মার কথা কেউ আর বলে না।.. তাই আত্মার উজ্জীবন আর হয় না। ... চমকে দেওয়ার জন্যেই তারা বই পড়ে, আত্মপুষ্টির জন্য নয়। বই পড়ার দরুন বুদ্ধিরই কসরৎ হয়, আত্মার অনুশীলন হয় না। মুখে মুখে আধুনিক ইন্টেলেক্চুয়াল বুলি, ভেতরে সেই অমার্জিত বর্বর মানুষটিরই বাস। ইন্টেলেক্চুয়ালিটিটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ছদ্মবেশ...। সকলেই চায় বিশ্বকে পরিবর্তিত করতে, নিজের রূপান্তরের দিকে কারোই ঝোঁক নেই। অথচ বিশ্বের চেয়ে নিজের ওপরই যে আমাদের অধিকার বেশী, নিজেকেই যে সহজে বদলানো যায়, সে কথাটা আমাদের মনে থাকে না। নিজেকে নীরবে ফুলের মতো বিকশিত করে তোলার আনন্দ আজ আর কেউ চায় না। .. করার দিকেই সকলের ঝোক, হওয়ার দিকে নয়। অথচ কাল্চারের উদ্দেশ্য যে কিছু করা নয়, কিছু হওয়া সুন্দর হওয়া, প্রেমিক হওয়া, নবীন হওয়া-এতো একরকম অবিসংবাদিত সত্য।’
‘যেখানে পশু-মানুষটি তলিয়ে গিয়ে মানুষ-মানুষটি বড় হয়ে ওঠেনা, যেখানে প্রতিযোগিতা, প্রতারণা, প্রতিহিংসা প্রভৃতি নীচপ্রবৃত্তিসমূহের জয়জয়কার সেখানে ক্রিয়েটিভিটি থাকতে পারে, কিন্তু সমজদারি নৈব নৈব চ । ...জীবন কোনদিন ফাঁকা থাকে না, আল্লা না থাকলে সেখানে শয়তান থাকেই, সুন্দর না থাকলে তা অসুন্দরের আস্তানা হয়ে পড়েই। ’‘অপরকে চমকে দেওয়া নয়, নিজেকে খুশী ও সুন্দর করাই সমজদারদের উদ্দেশ্য। ...মিথ্যা ঔজ্জ্বল্যে তারা তৃপ্ত হতে চায় না, ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ কিনতে তারা নারাজ।’...‘সমজদারি ব্যর্থতার দান, প্রতিভা প্রকাশ করতে গিয়ে যারা ব্যর্থ হয় সাধারণতঃ তারাই সমজদার হয়। অকৃতকার্যতাটা এখানে শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। তাই ব্যর্থতা জিন্দাবাদ না বলে উপায় নেই। ...সমজদারও সৃষ্টি করে, কিন্তু সে বই নয়, শিল্প নয়, নিজের অন্তরাত্মা, আর অন্তরাত্মার চেয়ে বড়ো সৃষ্টি আর কি হতে পারে ?’
‘বামন হয়ে যারা চাঁদের দিকে হাত বাড়ায় চাঁদের আলো কিছু-না-কিছু তাদের চিত্তে লেগে থাকেই চাঁদকে তারা হয়তো পায়না, কিন্তু চাঁদের আলোকে পায়। যারা একটা বড় জিনিস চেয়ে ব্যর্থ হয়, তাদের অন্তরে সেই বড় জিনিসের ছাপ না থেকে পারে না। তাই ছোট ব্যাপারে সার্থকতার চেয়ে বড় ব্যাপারে ব্যর্থতা অনেক ভালো। তাতে করে মানুষটি বড় হয়- তার ভেতরের কালিমা- কলুষ দুরীভূত হয়ে সে সুন্দর ও উজ্জল হয়ে ওঠে।’ তোমাকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে, চাঁদ না-আরও দূরের ‘মঙ্গল’ বা ‘বুধ’ স্বপ্নে বিভোর রাত জাগবে তুমি। [‘‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা তুমি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখ। স্বপ্ন তো তাই, যা তোমাকে ঘুমোতেই দেবে না’’] । বুধের নাগাল হয়ত পাবেনা, কিন্তু মঙ্গল তোমার পায়ে লুটাবে দেখ। আর যদি ব্যর্থই হও, ব্যর্থতার আলোয় রাঙবে তোমার জীবন। আমি মূক হয়ে রইলাম তোমার ব্যর্থতাকে বরণ করতে।
প্রতিষ্ঠাতা, স্টুডেন্ট অব দা ইয়ার।