পাছে লোকে কিছু বলে...

শামীম আখতার শিমুল blogs, Soty 2025-09-13

সোশ্যাল মিডিয়া প্রসঙ্গে সাকিব আল হাসানকে কিছুদিন আগে এক রিপোর্টার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনাকে নিয়ে যে এত আলোচনা-সমালোচনা হয়, আপনি এটাকে কীভাবে দেখেন ?’ মুচকি হেসে সাকিব বললেন, ‘দেখিই না।’

আচ্ছা, ম্যাচের আগে ও পরে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্টগুলো পড়লে, সাকিব কী এত ভালো খেলতে পারতো? মোটেও না। সাকিব জানেন, যারা মোটেও খেলা বোঝেন না, তারাই অনবরত উপদেশ ও গালি দিয়ে থাকেন ফেসবুকে। সাকিব বিশ্বাস করেন, ‘আমি খেলছি আর তারা তো শুধু দেখছে।’ ‘রেকর্ডের জন্য আমি খেলি না। বেশি ক্যালকুলেশন করে বেশি চাপ নিয়ে ফেললে খেলা ভালো হয় না।’ ‘খেলাটা উপভোগ করাটাই আসল।’ সাকিব আল হাসানের বাবা নিজেও খেলোয়াড় ছিলেন, ছেলেকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু সাকিব একটু বেশিই ক্রিকেট খেলতেন সারাক্ষণ ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকতেন। বিরক্ত হয়ে তিনি তিন-চারটা ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন। তাতে কি থেমে গিয়েছিলেন সাকিব? সাকিবের স্বপ্ন? মোটেও না। এক সাংবাদিক সাকিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্বপ্ন কী? সাকিব বলেছিলেন,“যা শুনলে লোকে চমকে উঠবে, লোকে বলবে, না, এটা সম্ভব নয়-তা হলো স্বপ্ন। যা হওয়া সম্ভব, যা ঘটানো সম্ভব, সেটা তো বাস্তব। বাস্তব জিনিসকে আমরা কেন স্বপ্ন বলবো? স্বপ্নের কথা শুনে লোকে যদি পাগলই না বলল, সেটা কখনোই স্বপ্ন নয়।” নিজের কাজের প্রতি এই ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রমই পারে কাজের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে সাকিব আল হাসান তৈরি করতে, পারে সব ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে !!

 

কেন সমালোচনা?

আপনি ভেবে দেখেছেন কি? যে মানুষগুলো লোকগুলো আপনাকে নিয়ে কটুকথা বলে সেই মানুষগুলো লোকগুলো আপনার চেয়ে কিছুটা হলেও পিছিয়ে আছে। যারা কাজের, তারা জানেন যে, সাফল্যের পথটা কত কঠিন। অনেক ব্যর্থতার যোগফল একটু সাফল্য, এটা তারা ভালোভাবে জানেন বলেই তারা কারো ব্যর্থতায় কটু কথা বলেন না। কটু কথা বলেন অযোগ্য ও ব্যর্থরা। কটু কথার আঘাতে যাতে আপনি থেমে যান, ফেসবুকের কমেন্টের আঘাতে যাতে তাদের দলে ভিড়ে যান, সেই প্রত্যাশায় তারা কটু কথা বলে। এটাতেই তাদের সুখ। তারা তো আপনার মতো সাহসী না, তারা তো আপনার মতো সৃজনশীলও না। আপনি কিছু করছেন, আর সে কিছুই করতে পারছে না, তাই সে প্রাণপণ চায়, আপনি ব্যর্থ হন। তাতেই যে তার ব্যর্থতার গ্লানি ও কষ্ট একটু হলেও লাঘব হয় যে। 
 

মার্টিন লুথার কিং এর মতে- "কিছু মানুষ তোমাকে পছন্দ করে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে তুমি তার কোনো ক্ষতি করেছ। তবু, তুমি তার কাছে স্রেফ অপছন্দের মানুষ। তোমার হাঁটা-চলা, কথাবার্তা অনেকের কাছেই ভালো লাগবে না। কেউ হয়ত তোমাকে অপছন্দ করে, কারণ তুমি তার চেয়ে ভালো কাজ জানো। তোমাকে লোকে পছন্দ করে, সেটাও অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ হতে পারে। তোমার চুল তাঁর চেয়ে সামান্য বড় বা ছোট, তোমার গায়ের রং তাঁর চেয়ে খানিকটা উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল। কেবল কারও কোনো ক্ষতি করলেই তুমি তাঁর অপছন্দের পাত্র হবে, তা নয়। অপছন্দ ব্যাপারটা আসে ঈর্ষাকাতরতা থেকে"।          
 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ‘অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দেওয়ার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে।’ ডেল কার্নেগি বলেছেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যায় সমালোচনা হচ্ছে আড়াল করা প্রশংসা। যার অর্থ হচ্ছে তুমি কারো হিংসা এবং পরশ্রীকাতরতার কারণ হয়েছ। মনে রেখো মরা কুকুরকে কেউ কখনো লাথি দেয় না।’ শিক্ষা ও কালচার যেখানে পশু মানুষটি তলিয়ে দিয়ে মানুষ-মানুষটি বড় হয়ে তুলতে পারে না, সেখানেই থেকে যায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা, প্রতারণা, প্রতিহিংসা, বিকৃত সমালোচনা, কুৎসা প্রভৃতি নীচ প্রবৃত্তি সমূহের জয়জয়কার। এটা শিক্ষার দৈন্য। শিক্ষার এই দীনতার জন্যই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কথার ছোবল থেকে আমাদের বাঁচার কোন উপায় নেই। লোকের কথাগুলোতে আমরা কতটা প্রভাবিত হচ্ছি সেটাই বিবেচ্য বিষয়। আচ্ছা- 
ক) সমালোচকের সমালোচনা কি বৃষ্টির মতোই কোমল ?            
খ) তার উদ্দেশ্য কি আপনার কাজ/চিন্তার ‘পরিচর্যা’?
গ) সেই মানুষটা সত্যিই আপনার ভালো চান কি?                       
ঘ) মানুষটি সেই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশী অভিজ্ঞ কি?

 

প্রশ্নগুলির উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে তাকে পাত্তা না দেয়াটাই জরুরি। আর যদি হ্যাঁ হয় তবে একটু পাত্তা দেওয়া যেতে পারে, কারণ সেটা নিন্দা নয়, সমালোচনা। তবে কে কী বলছে, তা খুব বেশী গুরুত্ব দেওয়া যাবে না, তবে কে বলছে, কেন বলছে আর কখন বলছে, তা বিবেচনা করতে হবে। অবশ্যই মাথায় রাখতেই হবে-    
ক) কারো মনোভাব পরিবর্তনের দায় কিন্তু আপনার না।
খ) লোকের কথাতেই তাদের মানসিকতার পরিচয় মেলে, আপনার না।
গ) কে কী ভাবলো তাতে কিছুই যায় আসে না, যদি না আপনার দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়।
ঘ) কোন মানুষই আপনাকে আপনার মতো করে গ্রহণ করবে না
ঙ) কথা আপনি বন্ধ করতে পারবেন না।                                   
চ) অন্যকে খুশি করে আপনার লাভ কী?
ছ) লোকে কি ভাববে, তা যদি আপনিই ভাবেন, তাহলে লোকে করবে কী?

 

সমালোচনা প্রয়োজন তবে..

জাতি হিসেবে আমাদের পছন্দ ‘হ্যাঁ’ এর সাথে ‘হ্যাঁ’ মেলানো, আর ‘না’ এর ‘না’। কথার সাথে তাল মেলানো লোককে সবাই পছন্দ করে। এই তাল মেলানো সংস্কৃতি আমাদের জন্য খুবই ভয়ংকর। এরা নতুন কিছু দিতে পারে না। বরং তাল না মেলানো লোকটির কাছ থেকে নতুন কিছু পাবেন। হোক সে ছোট, শুধু বয়সে ছোটদের জন্য না, পদমর্যাদা বা সামাজিক মর্যাদায় ছোটদের বেলায়ও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য। তরুণদের হয়ত অভিজ্ঞতা কম, কিন্তু তাদের আছে বুদ্ধির অভিনবত্ব। আপনার প্রকৃত ভুল কিন্তু সমালোচকই সর্বপ্রথম দেখতে পায়।      
 

এটা ভেবেই হয়ত রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পরনিন্দা প্রবন্ধে নিন্দুকের প্রশংসা করেছেন- ‘‘মহত্বকে পদে পদে নিন্দার কাঁটা মাড়াইয়া চলিতে হয়। ইহাতে যে হার মানে বীরের সদ্গতি সে লাভ করে না। পৃথিবীতে নিন্দা দোষীকে সংশোধন করিবার জন্য আছে তাহা নহে, মহত্বকে গৌরব দেওয়া তাহার একটা মস্ত কাজ।’’ তবে যাদের সমালোচনা মোটেও আমলযোগ্য নয়- 
ক) যারা সমালোচনার নামে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে।                
খ) যারা অন্যায়ের প্রতিবাদে বাধা দেয়। 
গ) যারা বিষয়ের বাইরে অযথা কথা বাড়ায়।                               
ঘ) যারা বোঝাতে চায়, তারা ভালো, তুমি খারাপ। 
ঙ) যারা সামনে তোমার গুণগান গায়, আর পেছনে নিন্দা করে।  
চ) যারা আপনার চিন্তার ‘পরিচর্যা’ নয়, ধ্বংস চায়।

 

সমালোচনা ও প্রতিবাদ

ভিত্তিহীন অযথা কথা শুনলে অনেকেরই তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদের ইচ্ছা জাগে। অনেকে জোর গলায় প্রতিবাদ করেও ফেলেন। কিন্তু এতে আপনার সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মনে রাখবেন, যে মানুষটি আপনাকে নিয়ে সমালোচনা করছে সে জেনে বুঝেই আপনাকে নীচু করার জন্য, আপনাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করার জন্য কাজটা করছে। এই সমালোচনার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। আপনি যখন প্রতিবাদ করতে যান তখন উলটো সে আরও খুশী হয়, কারণ সে বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মনে রাখবেন যখনই কেউ আপনাকে নিয়ে ভিত্তিহীন সমালোচনায় যায়, এর অর্থ সে আপনার উন্নতি কিংবা আপনার অবস্থানকে হিংসা করে। তার সমালোচনার মূল কারণ আপনাকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ভালো অবস্থান থেকে আপনাকে সরিয়ে আনা। সুতরাং ভিত্তিহীন সমালোচনার প্রতিবাদ না করে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের সেই বিখ্যাত কথাটা স্মরণ করতে পারেন- “What do you care what other people think?

 

তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উপেক্ষা করে গেলে ক্ষতি বেশি হয়। আরও একটি বিষয় মাথায় রাখবেন, যদি সব সময় আপনি মাথা নীচু করে চুপ থাকেন তাহলে আপনাকে নিয়ে সমালোচনার মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। যে-সব ক্ষেত্রে আপনার মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা সেসব ক্ষেত্রে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করুন। তবে আড়ালে আবডালে গসিপ করে নয়, বরং সরাসরি সমালোচনাকারীকে প্রশ্ন করুন, সমালোচনার কারণ জানতে চান। সাহসিকতার সাথে এদের সমালোচনার মোকাবেলা করুন কেউ আপনার সাথে থাকুক বা না থাকুক। যদি প্রতিবাদ করে নিজেকে ভিত্তিহীন তীব্র সমালোচনার হাত থেকে রেহাই দিতে পারেন তবে আপনার নিজের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে, বাড়বে আত্মবিশ্বাস। আর, প্রতিবাদ করতে না চাইলে, তখুনি তাকে মন থেকে ক্ষমা করে দেন, দেখবেন এক অদৃশ্য কারাগার থেকে মুক্তি মিলবে আপনার মনের। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত ক’জনের জন্য রাগ পুষে রেখেছেন মনে? আপনার রাগ বা অভিমানে কী বদল হয়েছে সেই ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ মানুষগুলোর লোকগুলোর? নিশ্চয় না। মাঝখানে নিজের রাগ-অভিমানের কারাগারে নিজেই বন্দী করেছেন নিজেকে, মনের আকাশটা মেঘে মেঘে ভারি করে তুলেছেন নিজেই। শুধু শুধু তাতে কষ্ট বেড়েছে আপনার। এখন থেকে হয় সামনাসামনি প্রতিবাদ করবেন। মনে রাখবেন, প্রতিবাদী মানুষটা যদি খারাপ হয়, তাহলে দেশে অনেক খারাপ মানুষ খুব দরকার। যারা সব অন্যায় ও শোষণের প্রতিবাদ করবে। চুপ করিয়ে রাখার বা দাবিয়ে রাখার সব রক্তচক্ষুকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। আর বদনাম বা কলঙ্ক? কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন সেই বিখ্যাত- ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধলো গাঁয়ে..’ গানটা মন দিয়ে দু-চারবার শুনলে সব খেদ দূর হয়ে যাবে, যাবেই।
 

তবুও জীবন..

জীবনটা জাস্ট একটা খেলার মাঠ। বল কখন নিজের কন্ট্রোলে থাকবে কখনও অন্যের। কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, ল্যাং মারবে, পা ভেঙ্গে দেবে। ধাক্কা খেয়ে তুমি কি কান্না জুড়ে দেবে? গোল হওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখে তুমি কি মাঠ ছেড়ে পালাবে? হলুদ কার্ড ও লাল কার্ডে তুমি মনোবল হারাবে? নিশ্চয় না। তুমি অবশ্যই ছুটবে বলের পিছু। নতুন উদ্যোমে কষ্ট করে বল কেড়ে তুমি গোলের চেষ্টা করবেই। গোল পোস্ট ফাঁকা পেয়েও গোল মিস হতে পারে, কিন্তু যেটা মিস হবে না, সেটা হলো গোল দেবার আপ্রাণ চেষ্টা। এই নিরন্তর চেষ্টাই হলো সফলতার আসল ম্যাজিক। 


সত্যি বলতে গেলে, আমরা সবাই অন্যকে নিয়ে কথা বলতে বেশি পছন্দ করি। তারচে বেশী পছন্দ করি, আমাকে নিয়ে অন্যেরা কী বলে, কী ভাবে, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে!! অন্যেরা কী বলবে,পাছে লোকে কিছু বলবে, এই ভয়ে এই আতঙ্কে ইঁদুর দৌড়ে দৌড়ানো অর্থহীন। জীবনটা খুব অল্প সময়ের, জীবনটা অনেক সুন্দর। এই সুন্দর জীবন ও সময়টা অন্যের জাজমেন্টের ভয়ে গুটিয়ে না রেখে, পিছু না হেঁটে, আতঙ্কে ইঁদুর দৌড় না দৌড়ে, যা কিছু আনন্দের, উপভোগের, তাতে অংশ নিতে হবে, উপভোগ করতে হবে, উদ্‌যাপন করতে হবে। মোদ্দাকথা, স্বপ্ন ও সুন্দরের অবগাহনে মত্ত থাকতে হবে। 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বক্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই- ‘‘বস্তুত নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না, সে ভালো কাজের দাম কী! একটা ভালো কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাই, ভালো গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে! জীবনকে ধর্মচর্চায় উৎসর্গ করিলাম, যদি কোনো লোক তাহার মধ্যে গূঢ় মন্দ অভিপ্রায় না দেখিল তবে সাধুতা যে নিতান্তই সহজ হইয়া পড়িল।’’