আমি মানুষ। আমি “সৃষ্টির সেরা জীব”। অন্য কোন প্রাণী সেটা জানে কিনা, মানে কিনা কিংবা জেনে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে কিনা তা জানি না। গণভোট হলে আমি শ্রেষ্ঠ হিসাবে জয়ী হতাম কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও, ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ এর মতো আমি নিজেকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মনে করি, প্রচার করি এবং গর্ব বোধ করি।
আমি টেলিভিশনের রঙ্গিন পর্দায় বাকের ভাই এর যৌক্তিক পরিণতি/ফাঁসির বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করি, ঘেরাও করি। নাটকের এই চরিত্রটির মৃত্যুতে শোভাযাত্রা করি, কুলখানি করি, চোখের পানি নাকের পানি এক করি। অন্যদিকে প্রতিবেশী বাকেরের প্রতি আমার যত ঘৃণা অবজ্ঞা, অবহেলা, করুণা। সিনেমার নায়ক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে ভিলেনের বুকে লাথি মারলে বা মুখে থুথু ছিটালে আমি করতালি দিয়ে সমর্থন করি। সাহসী, ত্যাগী, দেশপ্রেমী, মানবপ্রেমী, প্রতিবাদী, নিঃস্বার্থ ও উপকারী ‘সিনে-নায়ক’ এর প্রতি আমার সকল ভালবাসা, শ্রদ্ধা। কিন্তু জীবনের নায়ক হিসেবে কামনা করি স্বপ্ন দেখি অর্থ-বিত্তে-ক্ষমতায়, স্বার্থপরতায়, কপটতায় ও চৌর্যবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ কাউকে। চঞ্চলা-চপলা, সাহসিনী, বুদ্ধিমতী মেধাবিনী, প্রেমময়ী, দয়াবতী নারীকে উপন্যাস, নাটক বা রূপালী পর্দার নায়িকা হিসেবে বেশী ভালবাসি। জীবনের নায়িকাকে হতে হবে রূপসী, স্বল্পভাষিনী, মৃদ্যুহাসিনী, ধীরগামিনী ও মর্ষকামী যে চোখের জলে বুক ভাসাবে, সাত চড়েও মুখ খুলবে না, স্বামীর সকল আদেশ-অত্যাচারকে আশীর্বাদ মনে করবে। মাদার তেরেসা,নেলসন ম্যান্ডেলা হবে দূরের কেউ, পরিচিতকে হতে হবে আমার মত সাধারণ মানুষ। আর এ জন্যই মাদার তেরেসা,নেলসন ম্যান্ডেলার কাছ থেকে কিছুই শিখি না, শোক বইতে স্বাক্ষর করে তৃপ্ত হই। আমাদের ভাই-বন্ধু কিংবা আত্মজা মনুষ্যত্বের কথা মানবতার কথা নিঃস্বার্থ ভালবাসার কথা বললে আমি নাক সিটকাই। তাকে বোকা, নির্বোধ, গোল্লায় যাওয়া, বিগড়ে যাওয়া প্রভৃতি দ্বারা বিশেষায়িত করে নিরুৎসাহিত করি। তাকে ‘দেশ-প্রেম’ ও ‘মানব-প্রেম’ রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে আত্মপ্রেম এর দীক্ষা দান তখন আমার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ হিসাবে, অভিভাবক হিসাবে আমার দায়িত্ব আছে না?
আমি শ্রেষ্ঠ জীব। স্ববিরোধিতায় তো আর অন্য প্রাণীকে শ্রেষ্ঠ হতে দিতে পারি না। এজন্যই আমার মুখের ভাষা ও মনের ভাষা আলাদা। ক্ষমা, দয়া মানবিকতার আলোয় আলোকিত ইতিহাস খ্যাত নেতা, কবি, দার্শনিক, ধর্মের দেব-দেবী ও নবী রাসূলদের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা ভক্তি ও শ্রদ্ধা। জীবনাচারে তার কোন প্রতিফলন নেই। মুখে মনুষত্বের কথা বলছি, মানবতার কথা, প্রগাঢ় ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা বলছি কিন্তু ব্যক্তি আচার-আচরণের মাধ্যমে ভাই-বোন, আত্মজা ও শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছি অন্য কথা। শেখাচ্ছি ‘শিক্ষা’ মানে ‘তুমি’, ‘তোমার স্বার্থ’,‘তোমার সুখ’ ‘তোমার স্বপ্ন’ ‘তোমার ভবিষ্যত’।‘প্রেম’ মানে আত্মপ্রেম, উপকার মানে ‘বাবা আপন প্রাণ বাঁচা’। শেখাচ্ছি ‘দয়া’ মানে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। শেখাচ্ছি ‘যার বিবেক বেঁচে থাকে,তার সুখ মরে যায়। সুখী হওয়ার একমাত্র উপায় বিবেকহীন হওয়া’। এজন্য শিক্ষাঙ্গন গুলো থেকে প্রতি বছর শেয়াল-শকুনের মত স্বার্থপর, লোভী, তীব্র আত্মপ্রেমী, তীক্ষèবুদ্ধি ও প্রখর স্মরণ শক্তিসম্পন্ন একপাল গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না, বাড়ছে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন প্রাণী ও স্মরণশক্তির সার্টিফিকেট এর সংখ্যা। মসজিদ-মন্দির থেকে বের হচ্ছে কিছু টুপিওয়ালা-ধূতিওয়ালা।
আমি মানুষত্বের পক্ষে নই, মানবতার পক্ষে নই, আমি নিরপেক্ষ। রাজনীতিও আজ দুইভাগে বিভক্ত সরকারী ও বিরোধী, আমি দেশের পক্ষে নই। ইমাম থেকে শিক্ষক, বিচারপতি থেকে সেনাপতি যে পদই আমার হোক না কেন, আমি এখন যে কোন দলের। আমি সেক্রিফাইজ বুঝি না, বুঝি কম্প্রোমাইজ। কম্প্রোমাইজ ও নিরপেক্ষতার মুখোশে আসলেই আমি সুবিধাবাদী। দেশপ্রেম মানবপ্রেম ও ধর্ম আমার কাছে মুখোশ। মুখোশেও আমি শ্রেষ্ঠ:
“মুখোশ গেঁথে গেছে মুখমন্ডলে/ মানুষগুলো খুব বিপদে পড়েছে,/ আজ তাদের পড়তে হচ্ছে/ মুখোশের উপর মুখোশ/ মনে হয়,/ মুখোশেই বুঝি মানুষ পরেছে।”
আমার চোখ শকুনের চোখের মতো। শকুন যত উপরে উঠুক না কেন তার নজর থাকে নিচের দিকে, আমিও যে জাতে উঠি না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যত সার্টিফিকেটই অর্জন করি না কেন, আমার নজর থাকে অসুস্থ, দুর্বল, অসহায় মানুষের দিকে। অসহায় নিরুপায় সেই মানুষটার ভিতর বাহির ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে খাওয়াই আমার লক্ষ্য। আমি জোঁকের চেয়ে কম ‘রক্ত-খেকো’ নই। অন্য হিংস্র প্রাণির মত মাংস, স্বপ্ন, মেধা, অন্য উদ্ভিদের ফুল, ফল কান্ড, মূল ও রস চুষেই আমি বেঁচে আছি। জোঁক জোঁকের রক্ত পান করে না,কাক কাকের মাংস খায় না। আমিতো সর্বভুক প্রাণী,খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ স্তরের খাদক। তাই অন্য মানুষের রক্ত, সুখ, স্বপ্ন, শ্রম ও জীবন হজম করেই তৈরি করেছি আমার সভ্যতা, অট্টালিকা, পারমানবিক বোমা। প্রকৃতি ও পরিবেশের উপকার করা তো দূরের কথা, আমার জন্যই বিপন্ন পরিবেশ, প্রাণিকূল, বিপন্ন পৃথিবী।
হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে ভালবাসে না তাকে আল্লাহও ভালবাসে না’। “আল্লাহকে ভালবাসার ইচ্ছা থাকলে প্রথমে মানুষকে ভালবাসতে শেখো”। কিন্তু আমি খুব ভাল করে জানি আজকের দিনে মানবতার কথা, বিবেকের কথা, ত্যাগের কথা, ও দয়ার কথা বলে বোকারা। নিজের স্বার্থের চেয়ে অন্যের স্বার্থকে বড় করে দেখা মানে নিন্দা, অপমান, দুঃখ, লাঞ্ছনা টেনে আনা। আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, মানুষের নিকট কিছুই চাইবে না, আমি তাকে বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দেই”। কিন্তু আমার সকল চাওয়াই তো মানুষের কাছে অন্যের কাছে। তাইতো আমি অদৃশ্য স্রষ্টাকে বা পাথরের ঠাকুরকে পাশকাটিয়ে পূজা-অর্চনা করি, সেবা করি ও যাকাত দেই অফিসের বড় কর্তাকে, ডিসি-এসপি, এমপি-মিনিষ্টারকে, পীর-দরবেশকে। মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম এর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের মতো ঝঁকিপূর্ণ-দীর্ঘপথে যাওয়া আমার মতো বুদ্ধিমান ও সৃজনশীল মানুষের কি মানায়?
আজ মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয় তার কিছু দিতে পারার ক্ষমতার উপর। আজ, Every relationship based on give and take. প্রতিদানহীন বা নিঃস্বার্থ কোন সম্পর্ক আজ মানস-বিলাস মাত্র। দেওয়ার যোগ্যতা কমতে থাকার সাথে সাথে পাওয়ার যোগ্যতাও কমতে থাকে। উপার্জনহীন বা প্রতিবন্ধী বাবা-মার মূল্য সেজন্য বাড়ির কুকুর-বিড়ালের চেয়ে কম বৈ বেশি হয় না। কুকুর বেড়াল তো তাদের বাবা-মাকে সেবা করে না, খেতে পরতে দেয়না,শ্রদ্ধাও করেনা । আমি তা করলেতো কুকুর-বেড়ালের কাছে হেরে যাবো,তা কি আমি হতে দিতে পারি ?
পশুত্বেও যদি আমি শ্রেষ্ঠ না হতে পারি, তবে কিভাবে আমি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব ?
প্রতিষ্ঠাতা, স্টুডেন্ট অব দা ইয়ার।